ভাইকিং সিরিজ রিভিউ
⚠️ স্পয়লার এলার্ট
আমিও আগ্রহী হয়ে আছি প্রস্থানের জন্য। ভাগ্যদেবী আমায় ডাকছে নিজের ঠিকানায়।
ওডিন আমার জন্যে পাঠিয়েছেন যাদের, তাদের সাথে ভেলহাল্লায় বসে আমি গৌরবের সাথে পান করবো ‘আলে’ (বিয়ার) উঁচু আসনে দেবতা ওসিরের সাথে। আমার জীবনের দিনগুলো শেষ হয়ে গেছে। আমি হাসছি, আর আমি মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছি।
__রগনার লথব্রুকের মৃত্যু কাব্য
The Vikings
IMDb: 8.5/10
Genres: Drama, History
Countries of origin: Ireland, Canada
বড় বড় ঐতিহাসিক সিরিজের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, একটা প্রজন্ম সিরিজের সেই গল্পে শেষ হয়ে যায়, অন্য এক প্রজন্ম সেখানে চলে আসে।
 |
(image credit: History) |
ফলাফল, দর্শকদের হাতের মুঠোয় একজন মানুষের পুরো এক জীবনের কাহিনী চলে আসে। এতে দর্শকগণ সহজেই ভাবনার গভীরে হারিয়ে যান। সিরিজের গল্পের উপর ভিত্তি করে নয়া জিনিস, নয়া প্রেক্ষাপট আমাদের ভাবতে শেখায়। যখন আমরা আমাদের নিজেদের নিয়ে এই বাস্তব জীবনে নানান সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ভাবতে বসি, আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একক দিক থেকে চিন্তা করি। কিন্তু, এইসব সিরিজ আমাদেরকে ভাবতে শেখায় ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে, একই বিষয়ে, একই সমস্যার অনেকগুলা ব্যাখা দাঁড় করিয়ে।
ভাইকিংদের ইতিহাস বর্তমানে এক ধরণের সৌখিন শ্রেণির ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। অতীতেও হয়তবা ছিলো। তবে, ভাইকিংদের জানার পর তাদের ব্যপারে মুগ্ধ হবার মত তেমন কিছু দেখি না। হ্যা, তাদের মনে শিল্পবোধ ছিলো। সেটা সুন্দর। সেটা সব কালচারেই সুন্দর। এছাড়া?
ভাইকিং ছাড়াও এদেরকে ডাকা হতো
নর্সম্যান, নর্থম্যান ইত্যাদি নামে। আজকের সুইডেন, ডেনমার্ক এবং নরওয়েতে ছিলো এদের বসবাস।
এরপর তারা স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে ছড়িয়ে যায়। অবশ্য, তাদের দেশগুলোও স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশের তালিকার ভেতরেই। তারা যেসব দেশে স্যাটেল হয়েছিলো সেসব হচ্ছে, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, গ্রীণল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডের ওয়ালেস, নর্থ আমেরিকা সহ ইউরোপের নানান স্থানে।
#Also Read: Lal Singh Chaddha Movie Review
দ্যা ভাইকিংস সিরিজে যা দেখানো হয়েছে, মানে, এদের বৈশিষ্ট্যে যেসকল দোষ-গুণ ছিলো, তা কিন্তু অন্যান্য জাতিদের বেলাতেও দেখা মেলে। এরাই যে শুধু এমন ছিলো, তা কিন্তু না!
যেমন, রুশ কসাকদের কথা বলা যায়। যারা বাস করতো বিস্তীর্ণ স্তেপ প্রান্তরে গাবাদী পশুর পাল নিয়ে। যুদ্ধ করতো। লুট করতো। আবার আক্রমণের শিকারও হতো। আরব বেদুইনদের কথাও বলা যায়, যাদের ধর্মই ছিল লুটপাট করা।
তবে, ভাইকিংরা ছিলো জঘন্যতম এক শ্রেণির মানুষ। যারা লুট করতো। ধর্ষণ করতো। বাচ্চাদের মাথা থেঁতলে দিতো। আর প্রচন্ড পরিমাণে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলো। অডিন ছিলো তাদের প্রধান দেবতা। সমুদ্রেকে বলতো তাদের ‘মা’। আর থর ছিল তাদের রক্ষাকর্তা। এরা ঘৃণা করতো লোকি’কে। দেবতাদের ক্রোধকেও ভয় পেতো। সে জন্য জীবন্ত মানুষকে সেক্রিফাইফ করতো বেদীতে। অনেকটা আমাদের হিন্দুস্থানের নরবলি দেবার মতো ব্যপার।
এই সিরিজটা মূলত নরওয়ের ভাইকিংদের নিয়ে বানানো। যারা কাটাগাট নামের বন্দরে বাস করতো। যাদের লর্ড বা গোত্রপতি ছিলো অনেকগুলো। জীবিকা ছিল জাহাজে চড়ে লুটপাট করা। শিকার করা। নিজেদের মাঝে বানিজ্য করা। কিন্তু, খুব বাজে আবহাওয়ার দেশ হওয়ায় তারা অন্য কোথাও ঠাই খুজে বের করতে মরিয়া হয়ে উঠে। পরিচিত হয় ইংল্যান্ডের সাথে। ফ্রাঙ্কিশদের দেশ ফ্রান্সের সাথে। মুসলিম স্পেনের সাথে।
ইংল্যান্ড তাদের আক্রমণের শিকার হয় বেশ কয়েকবার। স্যাক্সনরা তাদের পরাজিতও করে। কিছু এলাকা ভাইকিংদের দিয়ে আবাদও হয়। লন্ডন ব্রীজ ভাইকিংরা ভেঙেও ফেলে। ফ্রান্সেও রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়। তবে ভাইকিংরা সেখানে সুবিধা করতে পারেনি।
সিরিজে দেখানো হয়, বয়ুন দ্যা আইরনসাইড, হ্যারাল্ড এবং তার ভাই আর ফ্লকি সারাসিনদের (মুসলিমদের) দেশে যায় এবং মানুষজনকে মেরে কেটে কিছু মুসলিম মহিলাকে হারেম থেকে তুলে নিয়ে আসে। বাস্তবে, ভাইকিংরা স্পেনে আক্রমণ করে এবং মার খেয়ে পালিয়ে যায় স্পেনের নানান জায়গায়। এরপর, উমাইয়ারা ফ্লীট বানানোতে জোর দেয়, ফলাফলে, ভাইকিংরা নৌপথে আক্রমণ করলেও স্পেনীশদের হাতে মার খায়।
তবে এই সিরিজে সব চাইতে অবাক লেগেছে রুশ ভাইকিংদের দেখে। যারা এক সময় বাস করত নরওয়েতে। পরে এসে বর্তমান ইউক্রেইনে ছড়িয়ে যায়। আর সেসময়ও কিয়েভ ছিল রুশ ভাইকিংদের রাজধানী। এরা ভাইকিং হলেও তাদের ভাষা কিন্তু রুশ ভাষা ই ছিলো।
রগনার লথব্রুকের চরিত্র ছিল প্রথম কয়েক সিজনে। আর তার ছায়া-চরিত্র ছিলো পুরো সিরিজটা জুড়ে। সে ছিল খামখেয়ালি। তবে ভাল যুদ্ধা। দেবতাদের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল দৃঢ়। তবে, অন্ধ ছিলো না।
আর সেই কারণেই সে তার সব চাইতে ঘনিষ্ট সহচর ফ্লকিকে শাস্তিও দিয়েছিল, তার পছন্দের খৃষ্টান বন্ধুকে হত্যার জন্য। রগনার সাহসী ছিল নিজের বেলায়, কিন্তু পরিবারের বেলায় সে ছিলো দুর্বল। এই জিনিসটা পৃথিবীর অনেক বড় বড় রাজা-সম্রাটদের মাঝেও দেখা মেলে। নিজের রক্ত বংশের প্রতি দুর্বল থাকাটা হয়তো দুর্বলতার কোনো চিহ্ন নয়! এটা সম্মান আর আনুগত্যের প্রতীক!
ভাইকিংদের স্বর্গের নাম হলো ভেলহাল্লা। আর সেটা একটা বিশাল হলের মতো। যেখানে একত্রিত হবে সব বীর যুদ্ধারা। যারা বীরত্ব দেখিয়েছে, তাদের মর্যাদা অনুযায়ী স্থান হবে সেখানে। সুন্দরী ভল্কেরিরা তাদের সঙ্গ দেবে। সুরা পান করবে। দেব-রাজ অডিন থাকবেন। ফ্রেয়ার থাকবেন। আরো থাকবেন নানান দেব-দেবী।
রগনার যেমন ছিলো, তার প্রথম স্ত্রী ল্যাগার্থাও তেমন সাহসী আর বিচক্ষণ ছিলো। এই মহিলা নিজে শান্তিপ্রিয় হলেও অনড় আর দৃঢ ছিল তার আচরণ। আর তাই ঝামেলাও বাঁধতো। অবশ্য তাদের বিচ্ছেদ ঘটে, প্রথম সন্তান বয়ুন ছোট থাকতেই।
নিজের স্বামী ছাড়া পর-পুরুষের বিছানায় শোয়া যদি অপরাধ হয়, তাহলে সেটা ভাইকিং সমাজে অহরহ ঘটতো। খুব খুব অল্প মেয়ে পারতো নিজেকে সামলে নিতে।
এই সিরিজে আরো একটা জিনিস বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে, সেটা হচ্ছে প্যাগানদের সাথে খৃস্টানদের লড়াই। এটা আসলে হয়েছিলো পুরো ইউরোপ জুড়েই। খৃস্টানরা ছিলো উগ্র আর ভাইকিংরা ছিলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ফলাফলে, লড়াই হতো ভালই।
নব্য খৃস্টানরা তাদের ফেলে আসা পুরাতন নর্স দেবতাদের যেমন ঘৃণা করতো, ভাইকিংরা যিশুর অনুসারীদের সেভাবে সন্দেহ করতো। পুরো সিরিজের প্রথম সিজনটা আমার কাছে কেন জানি খুব গোছানো মনে হয়েছিল আর পরের কয়েকটা সিজন মনে হয়েছে ঘোড়ার পিঠে বসে দুলছে। মানে, দেখেও তাল পাচ্ছিলাম না। তবে আস্তে আস্তে সিরিজের গভীরে ঢুকে যেতে সময় লাগেনি।
ভাইকিংদের কাছে এমন কিছুই নেই যা এডাপ্ট করে এবং নিংড়ে নিয়ে অন্য প্রজন্মের জন্য মহৎ কিছু বের হবে। তবুও জেনে রাখা উচিত কার ছিলো ভাইকিং। সিরিজ নির্ভর না হয়ে, এদের সম্পর্কে পড়াশোনা করলে হয়তো আরো ভালভাবে চেনা যাবে এদের। তবে, স্বল্প পরিচিতির জন্য এই সিরিজটা বেশ ভালই কাজে দিবে হয়তবা।
# কিছু কথা, যা সিরিজ দেখার সময় মাথায় ক্যাচ করেছে।
★ মানুষ তার প্রার্থনার সমান। সে কার পূজা করছে, এতে কিছু আসে যায় না। মানুষের প্রার্থনা যত দৃঢ় হয়, তার সক্ষমতা ততই বাড়ে। এতে স্রষ্টার কোনো হাত নেই। কারণ, মানুষ নিজেই স্রষ্টার প্রতিবিম্ব। তার সেরা সৃষ্টি।
★ মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী। মানুষ যুক্তিবাদী। এদেরকে নির্দেশের আওতায় আনা তখনই সম্ভব, যখন তাকে কোনো কিছুতে ‘বিশ্বাস’ করানো যায়। আগেকার দিনের রাজারা সেই জন্যই যুদ্ধে ঈশ্বরের নাম নিতেন। পুরোহিতদের সামনে রাখতেন।
এখনের দিনেও হচ্ছে সেসব, তবে এখনকার জনপ্রিয় ঈশ্বরের নাম জাতীয়তাবাদ। আর তার ধর্মের নাম পুঁজিবাদ।
★ রাণী সব সময়েই রাণী হয়ে থাকে। তবে রাজা পাল্টায়। এখানেই নারী-পুরুষের প্রধাণ আর প্রথম পার্থক্য।
(কিং কানুট এর সাথে বিধবা রাণীর আন্তরিক আচরণ প্রসঙ্গে)
★ যুদ্ধ হলো ভাগ্যের সত্যিকার অর্থের পরিক্ষা। এখান থেকে ফিরে আস মানে, স্বপ্নের মাঝে বাস্তবতাকে ফিরে পাওয়া।
(যুদ্ধ শেষে সবার ফিরে আসা প্রসঙ্গে)
★ মুঘল সম্রাট জহির উদ্দীন বাবুর একটা কথা বলেছিলেন,
সম্রাটদের আসলে আপন বলতে কেউ নেই! দুই পাঁজরের মাঝখানে ধুকধুক করতে থাকা হৃদয় আর তার তরবারি ছাড়া আর কেউ নেই।
(অন্তরঙ্গ অবস্থায় কিং কানুটের দরজায় কেউ নক করলে সে সবার আগে তরবারির দিকে হাত বাড়িয়েছিল, তরবারি ছাড়া রাজাও অসহায়!)
★ কোনো এক মুভিতে (আমেরিকা-আফগান যুদ্ধ বিষয়ক) এক আফগান কমান্ডার তার সংগী মার্কিন সেনাকে বলছিল, একজন যুদ্ধা মানে সব সময় ই যুদ্ধা। কিন্তু একজন সৈনিক মানেই সব সময়ের যুদ্ধা নয়। তোমাদের আর আমাদের মাঝে তফাৎ এটাই।
★ ঈশ্বর নিজেও চান না, মানুষ তার উপর নির্ভর করুক আর তিনি এঞ্জেল পাঠিয়ে তাদের সহায়তা করেন। বরং তিনি চান, মানুষ নিজেই সব কিছু করুক আর তার নামে জয়ধ্বনি দিক।
(র্যাগনার এর ফ্রেঞ্চ রাজসভায় আক্রমণ প্রসঙ্গে)
Post Tag: